রফতানি আয় ও প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্থনীতিতে আশা জাগালেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে টাকার মানও। ডলার বাঁচাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। যদিও মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা ও তা নিষ্পত্তির হার কমে গেছে। এতে উৎপাদন খাত শ্লথ হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেই চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট ২০২২-এ বলা হয়েছে, ২০২২ সালে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
টাকার এই অবমূল্যায়ন সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল করতে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ১৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে।
ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০২২ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ২ জানুয়ারি ডলারের আন্তব্যাংক বিনিময় হার ছিল ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা, যা ১ ডিসেম্বর দাঁড়ায় ১০৫ টাকা ৪০ পয়সায়।
মূলত, করোনা মহামারির পর বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বৈদেশিক মুদ্রার বাজার আরও খারাপ হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর চীনা ইউয়ান, ভারতীয় রুপি, জাপানি ইয়েন এবং ইন্দোনেশিয়ান রুপিসহ প্রধান আমদানি দেশগুলোর মুদ্রার উল্লেখযোগ্য দরপতন হয়েছে।
পাকিস্তানি রুপির ২২ শতাংশ দরপতন হয়েছে, যা সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জাপানি ইয়েনের দরপতন হয়েছে ১৪ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর মার্কিন ডলারের বিপরীতে ইউরোর দর ৬ শতাংশ এবং ইউকে পাউন্ড স্টার্লিংয়ের ১০ শতাংশ দরপতন হয়েছে।
তবে, ব্যতিক্রম ছিল রাশিয়া ও সিঙ্গাপুরের। ২০২২ সালে রাশিয়ান রুবল ও সিঙ্গাপুরি ডলারের দর বেড়েছে যথাক্রমে ২ শতাংশ ও ১ শতাংশ।
সর্বশেষ আগস্ট মাসের শুরুতে রিজার্ভ থেকে বিক্রির ক্ষেত্রে ডলারের দাম ৫০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই মাস না যেতেই
তৃতীয়বার টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে ডলারের বিনিময় হার ছিল ১০৯ টাকা।
সবমিলিয়ে গত ১ বছরে দেশে টাকার পতন হয়েছে ১৫ টাকা ৫ পয়সা। এক বছর আগে ডলার রেট ছিল ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা। সেই থেকে টাকার অবনমন ঘটেছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, টাকার এতো বেশি অবমূল্যায়ন অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, বিনিময় হার শক্তিশালী না হলে বৈদেশিক ঋণও কমে যাবে এবং বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ব্যয়বহুল হবে। আমদানিও ব্যয়বহুল হবে। ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল দুই বছর আগেই ধীরে ধীরে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটানো। কিন্তু, তখন তা করা হয়নি। এর ফলে এখন অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাইতে পারছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, এখন প্রতি ডলারে ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা পাচ্ছেন রফতানিকারকরা। রেমিট্যান্সে দেওয়া হচ্ছে ১০৯ টাকা। আর আমদানিতে লেনদেন হচ্ছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা।
গত বছর জুলাই শেষে মোট রিজার্ভ নেমে যায় ৩৯ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে। যদিও এখন সেটি আরও কমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থার (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক নিয়মে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৩২৬ কোটি (২৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন) ডলার। গত ৯ আগস্টের তথ্য অনুযায়ী, দেশের রিজার্ভ আছে ২ হাজার ৯৫৩ কোটি ডলার (২৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন) ডলার। তবে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রকৃত রিজার্ভে ৬২৭ কোটি ৬১ লাখ ডলার বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই প্রকৃত রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে।
টাকার মান কমলে সমস্যা কোথায়?
ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমতে থাকলে ঋণ পরিশোধে সরকারের চাপ বাড়বে। এতে বাড়বে ভর্তুকির পেছনে ব্যয় ও প্রকল্পের ব্যয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে। নীতি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ২০১২ সালের জুন শেষে দেশে ১ ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮১ দশমিক ৮৭ টাকা। ২০২১ সালের জুন শেষে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৮৪ দশমিক ৮০ টাকা। এ সময়ে টাকার অবমূল্যায়ন হয় মাত্র ৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
ডলারের দাম বাড়ায় ইতোমধ্যে সরকারের আর্থিক বোঝা বেড়েছে। শুধু তাই নয়, মূল্যস্ফীতিও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই নীতি বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছর খাদ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে ৪০ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা ভর্তুকি রাখা হয়েছিল। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সেই ভর্তুকি বাড়িয়ে ৫০ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা করা হয়েছে।
নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সম্ভাব্য ভর্তুকির জন্য বাজেটে ৬৬ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান যদি এক টাকা কমে, তাহলে আগামী বছর শুধু বিদ্যুৎ খাতেই ভর্তুকি ৪৭৪ কোটি টাকা বেড়ে যাবে।
টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সরকারের প্রকল্প ব্যয় ল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে নীতি বিবৃতিতে বলা হয়, অনেক সরকারি প্রকল্প, বিশেষ করে বড় (মেগা) প্রকল্প আমদানি পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এভাবে টাকার মান কমলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে। একই কারণে সরকারের ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়বে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে সরকারি ও সরকারি নিশ্চয়তাযুক্ত ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। পরের দুই অর্থবছরে এই ঋণ বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ৩৬ হাজার ৬০০ ও ৩৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু ডলারের বিপরীতে টাকার মান ১০ শতাংশ কমলে চলতি অর্থবছর শেষে সরকারি ও সরকারি নিশ্চয়তাযুক্ত ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৪০ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
Post a Comment